কবি ও প্রাবন্ধিক হুমায়ূন আজাদকে নিয়ে কবি ফরিদ কবিরের স্মৃতিচারণা



হুমায়ুন আজাদ আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। আবার ছিলেনও না। আমি সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। বাংলা আমার সাবসিডিয়ারি বিষয় ছিলো।

তাঁর ক্লাসে বেয়াদবি করার অপরাধে বেশ কয়েকবারই আমাকে ক্লাসরুম থেকে তিনি বের করে দিয়েছিলেন!
তাঁর সামনে সিগারেট খাওয়া নিয়েও একটা ঘটনা ঘটেছিলো। সেসব আরেকদিন বলা যাবে।
নব্বইয়ের দশকে বইমেলায় প্রায় নিয়মিতই তিনি আগামী প্রকাশনীর স্টলে বসতেন। সেখানে দেখা হলে কুশল বিনিময় হতো। টুকটাক কথাও। মাঝেমধ্যে এটাসেটা নিয়ে খোঁচাখুঁচিও।
একবার তিনি এক সাক্ষাৎকারে বললেন, বাংলাদেশের মাত্র পাঁচজন কবি ভবিষ্যতে টিকে থাকবেন! তাঁদের নামও তিনি জানাতে ভুললেন না! তাঁরা হলেন, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ ও হুমায়ুন আজাদ।

সাক্ষাৎকারটি ছাপা হবার দিন দুয়েক পরই তাঁর সঙ্গে আগামী প্রকাশনীর স্টলে দেখা। আমি আর কথাসাহিত্যিক মশিউল আলম সে সময় প্রায়ই আগামী প্রকাশনীর সামনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতাম এবং কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে তর্ক বাঁধাতাম।
সেদিন বললাম, স্যার, আপনার ইন্টারভিউ পড়লাম!
স্যার আমার দিকে ফিরে বললেন, তাই? কেমন লাগলো?
বললাম, ভালোই। তবে যাঁদের নাম বলেছেন তার সঙ্গে আমি একমত না।
স্যার বললেন, আমি তো তোমার হয়ে ইন্টারভিউ দেইনি!
আমি বললাম, তা ঠিক। তবে আল মাহমুদের নাম বাদ দেয়াটা বোধ হয় ঠিক হয়নি! তা ছাড়া, আপনার নামের আগে আমাদের অনেকের নাম আসবে, সেসব নাম আপনি বলেননি!
হুমায়ুন আজাদ একটা বইয়ে অটোগ্রাফ দিতে দিতে বিরক্তমুখে বললেন, তুমি এখন যাও। তোমার সঙ্গে পরে কথা বলবো।
আমরা ওখান থেকে সরে এলাম।

রাত আটটার দিকে কবি জাহিদ হায়দারসহ আমরা কয়েকজন তথ্যকেন্দ্রের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম। দেখি, হুমায়ুন আজাদ আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছেন।
সত্যি সত্যি তিনি আমাদের কাছেই এসে থামলেন। তাঁর সঙ্গেও ছিল কয়েকজন তরুণ! সাহসী কথাবার্তা বলার কারণে তিনি তরুণদের কাছেও বেশ জনপ্রিয় ছিলেন।
আমাদের সামনে দাঁড়াতেই জাহিদ হায়দার জিজ্ঞেস করলেন, হুমায়ুন আজাদ, আপনি কেমন আছেন?
প্রশ্ন শুনেই তিনি ক্ষেপে গেলেন! জাহিদ হায়দারকে বললেন, তুমি আমার ছাত্র, তুমি আমার নাম ধরে ডাকতে পারো না!
জাহিদ হায়দার জবাব দিলেন, আপনাকে আমি একজন আধুনিক মানুষ মনে করেছিলাম! কারণ আপনাকেও শামসুর রাহমানকে নাম ধরেই ডাকতে দেখেছি!
হুমায়ুন আজাদ বললেন, তুমি আর আমি এক নই।
জাহিদ হায়দার জবাব দিলেন, রাহমান ভাই আপনার এক দশকের সিনিয়র, আপনি তাঁকে নাম ধরে ডাকতে পারলে আমি কেন আপনাকে নাম ধরে ডাকতে পারবো না।
হুমায়ুন আজাদ তখন এক বেমক্কা জবাব দিলেন যেটি শোনার জন্য আমরা কেউ তৈরি ছিলাম না!
তিনি বললেন, দ্যাখো, আমি এমএ পাশ, আর শামসুর রাহমান তো বিএ পাশ!!

আরেকদিন বইমেলায় গিয়ে দেখি, তিনি অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। আমি তাঁর সামনে গিয়ে বললাম, স্যার, ভাবছি আগামীবার আমিও একটা স্টল দেবো। আপনি সেখানে বসলে হুহু করে বই বিক্রি হবে।
তিনি আমার দিকে আগুনচোখে তাকালেন, বললেন, তুমি দূর হও এখান থেকে।

তার পরের দিন আমার স্ত্রী ঝর্না ও মেয়ে মুগ্ধকে নিয়ে মেলায় গেছি। মেলার শেষ দিকে আমরা কয়েকজন তরুণ কবি-লেখকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আড্ডা দিচ্ছিলাম। হুমায়ুন আজাদ আগামী প্রকাশনী থেকে বেরিয়ে আমাদের দিকেই এগিয়ে এলেন। আমার সঙ্গে তাঁর যতো খোঁচাখুঁচিই হোক, তিনি হয়তো আমাকে মনে মনে পছন্দই করতেন! সেদিনও কী ভেবে তিনি আমাদের সামনে এসেই দাঁড়ালেন, বললেন, তোমরা আছো এখনো?
আমি এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আমার স্ত্রী ও কন্যার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে বললাম, স্যার, ইনি আমার স্ত্রী। আর এটা আমার মেয়ে।
স্যার আমার স্ত্রী ও কন্যার দিকে তাকালেন তারপর বললেন, তুমি এতো কুৎসিত, তোমার মেয়ে এতো সুন্দর হলো কী করে?
আচমকা তাঁর এমন কথা শুনে সকলেই সম্ভবত কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। আমিও কিছুটা বিব্রত। সম্ভবত ঝর্নাও।
আমি অপ্রস্তুত ভাবটা কাটিয়ে নিয়ে বললাম, কুৎসিত বাবার মেয়েরা স্যার সব সময় সুন্দর হয়। আপনি নিজের ঘরের দিকে তাকালেও ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন!
তিনি আর কথা না বাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন।

মানুষ আসলে দোষেগুণেই মানুষ!
হুমায়ুন আজাদের কবিতা টিকে থাকবে কিনা তা সময়ই বলে দেবে। তবে, এমন একজন সাহসী লেখক আবার কবে এ দেশে জন্ম নেবে তা বলা মুশকিলই।
আমাদের অধিকাংশ কবি-লেখককে এখন অনেককিছুই পরোয়া করে চলতে হয়। তা রাষ্ট্র হোক, দল হোক, প্রতিষ্ঠান হোক, বা হোক নিছক সাহিত্য সম্পাদক! তিনি অন্তত কাউকেই, কোনোকিছুকেই তোয়াক্কা করতেন না।
তাছাড়া, কবিতা বা উপন্যাস তাঁর না টিকুক, 'লাল নীল দীপাবলি', 'বাক্যতত্ত্ব', 'তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান', কিংবা 'দ্বিতীয় লিঙ্গ'-র মতো বইয়ের জন্য এদেশের পাঠক তাঁকে অনেকদিন মনে রাখবেন বলেই মনে হয়।
তাঁর জন্য অশেষ শ্রদ্ধা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. "তাছাড়া, কবিতা বা উপন্যাস তাঁর না টিকুক, 'লাল নীল দীপাবলি', 'বাক্যতত্ত্ব', 'তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান', কিংবা 'দ্বিতীয় লিঙ্গ'-র মতো বইয়ের জন্য এদেশের পাঠক তাঁকে অনেকদিন মনে রাখবেন বলেই মনে হয়"

    আপনি আজাদকে বুঝতে পারেননি, মাপতে পারার তো প্রশ্নই আসেনা। আপনার প্রতিও শ্রদ্ধা।

    উত্তরমুছুন