নার্সিসিজম কথাটি যেখান থেকে এসেছে



আমরা প্রায়শই একটা কথা শুনি-নার্সিসিজম বা নার্সিসিস্ট। কেউ যখন নিজেই নিজের রূপ গুণের প্রশংসায় মত্ত থাকে বা নিজের দোষ যার চোখে পড়ে না সেসব ক্ষেত্রে নার্সিসিজম ও নার্সিসিস্ট কথাটি ব্যবহৃত হয়। এখন প্রশ্ন হলো কথাটি এলো কোথা থেকে। এটা জানতে হলে আমাদের ঢু মারতে হবে গ্রীক পুরাণে। 


নার্সিসাস ছিল অসম্ভব রূপবান একজন যুবক। গ্রীক উপকথায় শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্যের অধিকারী পুরুষদের মধ্যে অন্যতম একজন। তার আকর্ষনীয় দেহ, চওড়া কাঁধ, পেটানো বুক, মসৃন উরুদেশ, সোনালী গাত্রবর্ণ এবং কামদিপ্ত হাসিতে কেবল মাত্র মর্তের নারীদেরই নয়, পাগল করেছিল স্বর্গের অপ্সরাদেরও। পাহাড়ি পরী আর জল পরীরা তার সাথে একবার মিলিত হওয়ার জন্য ছটফট করতো। কিন্তু নার্সিসাস ছিল বেজায় বেরসিক। হাজারো নারী, পরী আর অপ্সরাদের দেহে কামনার আগুন জ্বেলে সে অধরাই রয়ে যেত। কাউকেই সে নিজের যোগ্য মনে করত না।


নদীর দেবতা সিফিসাস আর পরী লিরিউপির মিলনে জন্ম হয় তার। অন্ধ জ্যোতিষী টাইরেসিয়াস শিশু নার্সিসাসের ভবিষ্যত সম্পর্কে হুশিয়ারী দিয়েছিল ' নার্সিসাস যেন কখনোই নিজেকে না দেখে, যেদিনই সে তার প্রতিবিম্ব দেখবে সেদিনই তার জীবনে শনি নেমে আসবে'।


এদিকে 'ইকো' ছিল অনিন্দ্যসুন্দরীবনপরী। কোমল দেহবল্লভী, অনাবৃত স্তনযুগল আর লাল ঠোট যেন কামনার প্রতিক। তার শারিরিক আহ্বানে দেবতা জিউস পর্যন্ত স্বর্গ থেকে অলিম্পাস পর্বতে নেমে আসতো। দেবতা জিউসের সাথে মিলিত হওয়ার সময় একবার হাতেনাতে ধরা পড়ে দেবী হেরা (জিউসের স্ত্রী) র কাছে। হেরাকে কথার জ্বালে ভোলানোর চেষ্টা করলে হেরা তাকে অভিশাপ দিল যেন সে কখনই নিজে থেকে কথা বলতে না পারে। বোকার মতো মানুষের কথার প্রতিধ্বনি করতে পারবে শুধু।


এই ইকো ছিল নার্সিসাসের সৌন্দর্যের পাগল। নার্সিসাসকে যৌনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার জন্য দিনের পর দিন ইকো পথ চেয়ে থাকতো।


নার্সিসাস বনে যেত শিকার করার জন্য। বনপরী ইকোও তাঁর পিছু পিছু ঘুর ঘুর করতো। ভাবতো হয়তো একবার হলেও নার্সিসাস তাঁর দিকে তাকাবে। একদিন নার্সিসাস যখন বনের মধ্যে ঘুরছিলো তখন কারো পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলো। সে জিজ্ঞেস করলো “কে ওখানে?”


ইকো প্রতিউত্তর করলো, “ কে ওখানে...”।


নার্সিসাস আবার বললো, “এদিকে এসো”।


ইকো প্রতিউত্তর করলো, “ এদিকে এসো...”।


নার্সিসাস মহাবিরক্ত হয়ে বললো


“তুমি আমার প্রতিধ্বনী কেন করছো?...সামনে এসে আমার সাথে দেখা করো”।


ইকো আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলো, কারণ স্বয়ং নার্সিসাস তাকে আহ্বান করেছে! তার


কতো আশা নার্সিসাসকে বলবে সে কে এবং তার হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা শুধুই নার্সিসাসের জন্য রাখা। কিন্তু হায়! সে নিজে থেকে কথা বলতে পারেনা। সে ছুটে গেলো নার্সিসাসের দিকে এবং নিজেকে ছুঁড়ে দিলো ওর বুকে। নার্সিসাস প্রচন্ড রেগে গিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল, বললো 'তুমি কখনই আমাকে পাবেনা। কারন তুমি আমার যোগ্য নও।'


অপমানে ইকো নীল হয়ে গেল, লজ্জায় পালিয়ে গেল ওখান থেকে। আক্ষেপ, কষ্ট আর অপমানে একসময় সে মারা গেল।


তার এহেন মৃত্যুতে প্রতিশোধের দেবী নেমেসিস রুষ্ঠ হয়ে নার্সিসাস কে অভিসম্পাত করলো 'তুমি যাকে ভালোবাসবে তাকে কখনই পাবেনা, তাকে না পেয়ে কামনার আগুনে তুমি জ্বলে জ্বলে মরবে।'


এক রৌদ্রজ্জ্বল দিনে নার্সিসাস একটা জলাশয়ের ধারে এলো। সে যখনি জলের দিকে তাকালো, দেখলো এক অপূর্ব জলদেবতা জল থেকে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। আদতে ওটা ছিল তার নিজেরই প্রতিবিম্ব, যেহেতু নার্সিসাস কখনই নিজেকে দেখেনি তাই সে তার প্রতিবিম্বকে জলদেবতা ভেবে সাথে সাথেই প্রতিবিম্বের প্রেমে পরে গেলো। মন্ত্রমুগ্ধের মত নার্সিসাস তার প্রতিবিম্বকে চুম্বন করতে গেল কিন্তু পানিতে ঢেউ তৈরি হওয়াতে সেই অপুর্ব জলদেবতা হারিয়ে গেল। জল শান্ত হলে জল দেবতা আবার ফিরে এলো। এবার নার্সিসাস জলদেবতাকে অনুরোধ করে বললো একবার তার সাথে মিলিত হতে। কিন্তু জজল দদেবতা উঠে এলোনা। নার্সিসাস জলদেবতাকে টেনে তুলতে হাত বাড়িয়ে জল স্পর্শ করলো, দেবতা আবার হারিয়ে গেল।


জল স্পর্শ করলেই যেহেতু জলদেবতা হারিয়ে যায় তাই ভয়ে নার্সিসাস আর জলের দিকে হাত বাড়াল না। শুধু মন্ত্রমুগ্ধের মত নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থাকতো। সে নাওয়া খাওয়া ছাড়লো, তার সাধের শরির নষ্ট হয়ে যেতে লাগলো, সেদিকে তার বিন্দুমাত্র লক্ষ রইলোনা। সে একমুহুর্তের জন্যও জল থেকে চোখ সরালো না। চোখ সরালেই হয়তো তার ভালোবাসার মানুষটা পালিয়ে যাবে।


তার মৃত্যু হল নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে। সে কখনোই জানলোনা যে সে যার প্রেমে পড়েছে সে আর কেউ নয় খোদ নিজেরই প্রতিবিম্ব। সে পড়েছিল খোদ নিজেরই প্রেমে।


পুনশ্চঃ তার এই ঘটনা থেকেই এসেছে নার্সিজম (Narcissism) শব্দটি। যার অর্থ আত্মপ্রেম বা নিজের সাথে প্রেম।


বিঃ দ্রঃ গ্রীকপুরাণ প্রেম গাথার জন্য বিখ্যাত। অথচ সেখানে প্রেমের চেয়ে যৌনতাকেই অধিকতর প্রকট রূপে তুলে আনা হয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ