আমাদের পশু প্রেম ও চিড়িয়াখানা প্রীতি

আমাদের দেশে করোনাকাল যখন থেকে শুরু হলো এবং এদেশের মানুষজন যখন থেকে ঘরবন্দী হয়ে গেলেন, তখন তাদের একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবতে এবং সেই ব্যাপারে খুব ব্যথিত হতে দেখা গেল। তারা নিজেদের গৃহবন্দী অবস্থার সাথে সারাবিশ্বের চিড়িয়াখানায় বন্দী পশুদের মধ্যে মিল খুঁজে পেলেন। 

 

যাদের বন্য পরিবেশে একটা স্বাধীন জীবন পার করার কথা ছিল, তারা এভাবে সারাটা জীবন খাঁচায় বন্দী অবস্থায় পার করছে এবং সেটা যে সত্যিই ভীষণ কষ্টের ও অমানবিক, এই বিষয়টা যেন গৃহবন্দী প্রতিটি মানুষই বুঝতে পেরেছিলেন বা এখনও পারছেন। বিষয়টা ভেবে ব্যথিত হয়েছেন অনেকেই। খুব জোরালো বা এই নিয়ে বিশেষ কিছু লেখালেখি না হলেও অনেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কথা বলেছেন ‘চিড়িয়াখানা’র বিপক্ষে।

 

অতিপ্রাচীন কাল থেকেই মানুষ বন্য প্রানী বন্দি করে রাখতেন বা পোষ মানাতেন। আবার অনেক ধনী ব্যক্তিরা নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের জন্যও ব্যক্তিগত ভাবে পশু-পাখি সংগ্রহ করে খাঁচায় বন্দি অবস্থায় রাখতেন। খ্রিস্ট পূর্ব ২৫০০ সালের প্রাচীন মিশর ও মেসোপটেমিয়ার প্রাপ্ত ‘প্রাচীর খোদাই’ হতে তৎকালীন শাসক ও অভিজাত শ্রেণির এরকম প্রানী সংরক্ষণের কথা জানা যায়। কিন্তু সেগুলো চিড়িয়াখানা সদৃশ ছিল না। এবং এগুলো মেনেজারিস নামে পরিচিত ছিল।

 

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এর বরাদে আধুনিক চিড়িয়াখানার যে ইতিহাসটা জানা যায় তা হলো— আনুমানিক খ্রিস্ট পূর্ব ১২৫০ সালে প্রাচীন মিশরীয় রেকর্ড থেকে বন্দিদশায় থাকা পাখি, সিংহ এবং জিরাফের বর্ণনা পাওয়া যায়। পৃথিবীর প্রথম আধুনিক চিড়িয়াখানা টি গঠিত হয় ১৭৯৩ সালে, ফ্রান্সের প্যারিসে। আর আমেরিকান জু এন্ড একুইরিয়াম এসোসিয়েশন এর মতে বর্তমানে পৃথিবীতে দশ হাজারেরও বেশী চিড়িয়াখানা আছে।

 

প্রধানত বন্য পশু, পাখি ও জলজ প্রাণি সংরক্ষণ ও গবেষনার জন্য চিড়িয়াখানা তৈরী করা হয়। কিন্তু বর্তমানে যে উপায়ে প্রাণিদের সংরক্ষণ করা হয় তা কতটা তাদের সংরক্ষণে ভূমিকা রাখছে সে ব্যাপারে দ্বিমত আছে অনেকেরই। কিংবা প্রাণি সংরক্ষণের উপায় টা হতে পারতো আরও বেশী প্রাণিবান্ধব, ছোট খাঁচায় বন্দি অবস্থায় না রেখে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে মানবসৃষ্ট বনে বিচরণের ব্যবস্থা করা যেত। উপযুক্ত পরিকল্পনা থাকলে পশুদের মুক্তি দেওয়া যেত এমন খাঁচাবন্দী জীবন থেকে। বর্তমানে চিড়িয়াখানা গুলো প্রাণি সংরক্ষণের তুলনায় প্রাণি প্রদর্শনকেই মুখ্য করে তুলেছে। তাছাড়া অনেকসময়ই এইসব প্রানিদের সমগ্র জীবন কেটে যায় অমন বন্দিদশায়, যা কিনা খুবি অমানবিক। বিভিন্ন সময়ে মানুষ এটা বুঝতে পারলেও এই করোনাকালে তা যেন আরও ভালো ভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে।

 

কিন্তু এই বুঝতে পারাটা কতদিনের? কতদিন তাদের মধ্যে চিড়িয়াখানায় বন্দী এইসব পশু-পাখিদের জন্য মায়া থাকবে?

 

আমি হলফ করে বলতে পারি, কাল যদি করোনার দিন শেষ হয়ে যায়, পরশুদিনই আমরা ছুটোবো চিড়িয়াখানার দিকে। তখন নিজেদের বন্দী অবস্থার দুঃখ ভুলে যাবো, ভুলে যাবো এইসব পশুদের বন্দী জীবনের দুঃখ-কষ্ট। সব ভুলে আমরা সানন্দে চিড়িয়াখানা ঘুরে বেড়ানো, বানরের দিকে ছুঁড়ে দিবো বাদাম! ওদের দুঃখ আমাদের চোখে পড়বে না, আমরা সপরিবারে হাসিখুশি মনে চিড়িয়াখানা দেখে বাড়ি ফিরবো।

 



এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, চিড়িয়াখানা তো আমরা বানাই নাই, চিড়িয়াখানা যেহেতু আছে দেখতে যাওয়ায় অন্যায় কী? আর আমরা যারা সাধারন জনগণ, এখানে আমাদের করার কীই আছে?

 

সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আরো কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক। আচ্ছা, পর্নোগ্রাফি কেন তৈরী করা হয়? ধুমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে খারাপ তবুও সেগুলো কেন তৈরী করা হয়? কিংবা আমাদের দেশে ঝাটকা নিধন আইনত অপরাধ তবুও জেলেরা ঝাটকা কেন ধরে?

 

প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর প্রায় একি রকম। উত্তর টা হলো, আমাদের চাহিদা। আমাদের চাহিদা আছে বলেই এসবের যোগান দেওয়া হয়। আজ যদি দুনিয়ার সবাই পর্নোগ্রাফি দেখা বন্ধ করে দেয় তাহলে আর কেউ এসব বানাতে চাইবে না, ধুমপান কেউ না করলে জন্ম হবেনা কোন সিগারেটের, আপনি ঝাটকা কেনা বাদ দিলেই ঝাটকা মারবে না কোন জেলে। পৃথিবীর ভালো মন্দ বিবেচনা না করে কেবল নিজের লাভের জন্য যারা এসব যোগানের ব্যবস্থা করেন তারা অবশ্যই অপরাধী। তবে একটা কথা মনে রাখা ভালো, যারা যোগান দেন তারাই যে কেবল অপরাধী তা নয়, অপরাধী তারাও যাদের এসব চাহিদা আছে।

 

অবশ্য এখন যদি কেউ বলেন সারাবিশ্বে এত অস্ত্র-শস্ত্র বা পারমাণবিক বোমা কেন তৈরী হচ্ছে, তার সদুত্তর আমার কাছে নাই। বিশ্ব নেতারা ভালো বলতে পারবেন। এটুকু বোঝা যায়, মানুষ মারা উনাদের অন্যতম মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে, তাই আগ্নেয়াস্ত্র তাদের প্রধানতম চাহিদা।

 

এখন আসি মূল বিষয়ে। যেভাবে পর্নোগ্রাফি বা নিকোটিন প্রস্তুতের পিছনে মানুষের বিপুল চাহিদা দায়ী ঠিক একই ভাবে এইসব চিড়িয়াখানা গড়ে ওঠার পিছনেও দায়ী মানুষের চাহিদা। অর্থাৎ আপনি আমি টাকা দিয়ে টিকেট কেটে চিড়িয়াখানায় যাই বলেই পশুদের বন্দী করা হয় চিড়িয়াখানায়, তাদের কে যাপন করতে হয় এমন কষ্টকর জীবন। আমরা যদি চিড়িয়াখানায় যাওয়া বাদ দেই তাহলে হয়ত পৃথিবী থেকে উঠে যেতে পারে এমন অমানবিক একটা বিষয়। চিড়িয়াখানার বদলে গড়ে উঠবে প্রাণীদের জন্য অভয়ারণ্য। বন্দীদশা থেকে মুক্তি পাবে পৃথিবীর সকল প্রাণী।

 

লিখেছেন: দীপক কর্মকার


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. Time will change one day. The Man-made Ecosystem named "Safari Park" is increasing day by day. There all wild animals are free to move and people are allowed into case to see them. We wish one day such type of "Safari park" will increase more in number and the animals will get free from so called zoo.

    উত্তরমুছুন