নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ ( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর



আজি এ প্রভাতে রবির কর

কেমনে পশিল প্রাণের পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে
প্রভার-পাখির গান।
না জানি কেনরে এত দিন পরে
জাগিয়া উঠিল প্ৰাণ।
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,
ওরে উথলি উঠেছে বারি,
ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ
রুধিয়া রাখিতে নারি ।


থর থর করি' কাঁপিছে ভূধর,
শিলা রাশি রাশি পড়িছে খ'সে,
ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল
গরজি উঠিছে দারুণ রোষে।
হেথায় হোথায় পাগলের প্রায়
ঘুরিয়া ঘুরিয়া মাতিয়া বেড়ায়,
বাহিরিতে চায়, দেখিতে না পায়
কোথায় কারার দ্বার।
প্রভাতেরে যেন লইতে কাড়িয়া
আকাশেরে যেন ফেলিতে ছুঁড়িয়া
উঠে শূন্য পানে পড়ে আছাড়িয়া
করে শেষে হাহাকার।
প্রাণের উল্লাসে ছুটিতে চায়,
ভূধরের হিয়া টুটিতে চায়,
আলিঙ্গন তরে ঊর্ধ্বে বাহু তুলি
আকাশের পানে উঠিতে চায়।
প্রভাত-কিরণে পাগল হইয়া
জগৎ মাঝারে লুটিতে চায়।
কেনরে বিধাতা পাষাণ হেন,
চারি দিকে তার বাঁধন কেন।
ভাঙ্‌রে হৃদয় ভাঙ্‌রে বাঁধন,
সাধ্‌রে আজিকে প্রাণের সাধন,
লহরীর পরে লহরী তুলিয়া
আঘাতের পরে আঘাত কর্‌;
মাতিয়া যখন উঠিছে পরান,
কিসের আঁধার, কিসের পাষাণ,
উথলি যখন উঠিছে বাসনা,
জগতে তখন কিসের ডর।
আমি—ঢালিব করুণা-ধারা,
আমি–ভাঙিব পাষাণ-কারা,
আমি—জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া
আকুল পাগলপারা।
কেশ এলাইয়া, ফুল কুড়াইয়া,
রামধনু-আঁকা পাখা উড়াইয়া,
রবির কিরণে হাসি ছড়াইয়া,
দিবরে পরান ঢালি।
শিখর হইতে শিখরে ছুটিব,
ভূধর হইতে ভূধরে লুটিব,
হেসে খল খল, গেয়ে কল কল,
তালে তালে দিব তালি।
তটিনী হইয়া যাইব বহিয়া—
যাইব বহিয়া—যাইব বহিয়া—
হৃদয়ের কথা কহিয়া কহিয়া,
গাহিয়া গাহিয়া গান,
যত দেব প্রাণ ব'হে যাবে প্রাণ
ফুরাবে না আর প্রাণ।

এত কথা আছে, এত গান আছে,
এত প্রাণ আছে মোর,
এত সুখ আছে, এত সাধ আছে,
প্রাণ হয়ে আছে ভোর।
কী জানি কী হোলো আজি, জাগিয়া উঠিল প্রাণ,
দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান।
ওরে চারিদিকে মোর
এ কী কারাগার ঘোর।
ভাঙ্‌ ভাঙ্‌ ভাঙ্‌ কারা, আঘাতে আঘাত কর্‌।
ওরে আজ কী গান গেয়েছে পাখি,
এয়েছে রবির কর।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ