হুমায়ূন আহমেদ : উনার সাথে আমার যেদিন দেখা হয়েছিল


বাবার কফিনে পাশে নুহাশ এবং শিলা


আমরা তখন বড় হচ্ছি । তখন হয়তো প্রাইমারী স্কুলে পড়ছি কিংবা সবে হাই স্কুলে  উঠেছি । সেই বয়সে, শহরের কথা জানি না, গ্রামে অন্তত ঐ বয়সে পাঠ্য বই এর বাইরে উপন্যাস তো দূরের কথা গল্পের বই পড়াও আমাদের জন্য এক অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা ছিল । তবে পড়ার সময় কেউ দেখে ফেললে তা বিশেষ অপরাধ হত না বা গাল-মন্দ শুনতে হবে এমন টা না, কিন্তু 'ঠেস মারা' কথা শোনার একটা সম্ভবনা থাকতই। এই লজ্জ্বায় আমরা কখনো গল্প বা উপন্যাসের বই হাতে নিতাম না । নিলেও লুকিয়ে ছাপিয়ে পড়তাম । উপন্যাসটা ঠিক বাচ্চা কাচ্চাদের জন্য না- এই কথা জানা সত্বেও একদিন একটা উপন্যাস নীরবে নিভৃতে পড়ে ফেলেছিলাম । উপন্যাসের নাম-- তোমাদের এই নগরে, লেখক-- হুমায়ূন আহমেদ, গল্পের নায়ক-- হিমু । মজার ব্যাপার হলো আমি তখনো হিমু বা হুমায়ূন আহমেদ কাউকেই চিনি না । কিন্তু এক অদ্ভুত ভাললাগা তৈরী হয়েছিল হিমুর প্রতি, হুমায়ূন আহমেদের প্রতি ।

হুমায়ূন আহমেদের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল এর কিছু দিন পরে । তবে কোন ভাল ঘটনার মধ্য দিয়ে নয়, আমাদের চোখে তখন তা ছিল একটি 'খারাপ ঘটনা' । সম্ভবত সেই সময়টা ছিল হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে খারাপ সময় । আমার ধারনা-- স্বাধীন দেশে যখন হুমায়ূন আহমেদের পুরো পরিবার কে ঘর ছাড়া করা হয়েছিল, নব্য বিবাহিতা বউ কে নিয়ে যখন গাছ তলায় দাঁড়াতে হয়েছিল, সেই সময়ের চেয়েও যেন কঠিন পরিস্থিতিতে উনি পড়েছিলেন, যখন তিনি দ্বিতীয় আরেকটি বিয়ে করলেন । শুধু কেবল আপনজনেরা নয়, উনার অনেক ভক্তও হতাশ হয়ে পড়েছিলেন, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন উনার দিক থেকে । সেই অস্থির সময়ে আমি হুমায়ূন আহমেদ নামক মানুষটি কে জানলাম । অবশ্যই সেই জানা কোন সুন্দর কিছু ছিল না ।  

পুত্র নুহাশ হুমায়ূনের সাথে

তার পরের গল্প অবশ্য ভিন্ন । কলেজপড়ুয়া ছাত্র আমি । ততদিনে কত উপন্যাসই না পড়ে ফেলেছি । শরৎ, সমরেশ, সুনীল এর বইও পড়ে ফেলেছি গোটা কতক । আর হুমায়ূন আহমেদ! ততদিনে হুমায়ূন আহমেদের হিমু, মিসির আলী, শুভ্র'র সাথে আমার ভালভাবেই পরিচয় হয়ে গেছে । নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, আজ আমি কোথাও যাবো না, যদিও সন্ধ্যা'র দুঃখ বুকে পুষতে শুরু করেছি । উনি জোছনা ভালোবাসতে শিখিয়েছেন, ভালোবাসতে শিখিয়েছেন বৃষ্টি কে । মন্ত্র মুগ্ধের মত উনার নাটক-সিনেমা সবেরই ভক্ত হয়ে গেছি ততদিনে (আমার মনে আছে, কোথাও কেউ নেই নাটকটা দেখে কয়েকদিন থম মেরে ছিলাম) । সবাই কে ছাপিয়ে হুমায়ূন আহমেদ তখন আমার প্রিয় লেখক হয়ে উঠেছেন । একদিন এই মহান লেখকের সাথে আমার দেখা হয়ে হয়েছিল । সেই এই গল্পটা একটু পরে বলি ।

মা বেগম আয়েশা ফয়েজের সাথে

আজ এই সময়ে দাঁড়িয়ে, যখন তিনি আমাদের মাঝে আর নেই, তখন আমরা যারা হুমায়ুন ভক্ত, তাঁকে আমরা নির্দ্বিধায় ভালবাসি, শ্রদ্ধা ভরে স্মরন করি । এখন যেন তাঁর প্রতি ভালবাসাটা বেড়ে গেছে আরও বহুগুণ । উনার সমালোচকেরাও মানেন তিনি এই বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক । সহজেই কেউ তাঁকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে না । উনার অনুপস্থিতি পাল্টে দিয়েছে অনেক কিছু ।

আজ আমরা গুলতেকিন খান, তার তিন কন্যা এবং পুত্র নূহাশ হুমায়ূন কে যেমন ভালবাসি, তেমনি নিষাদ, নিনিত কেও ভালবাসি, আমরা মেহের আফরোজ শাওন কেও মেনে নিয়েছি । শুধু এক দুঃখ,  আজ যখন সবকিছু সহজ সুন্দর হয়ে গেছে, আজ আর তেমন জল ঘোলা হয় না উনার ব্যক্তি জীবন নিয়ে (অন্তত উনার ভক্তেরা করেন না), উনার বই, উনার চরিত্রেরা, উনার কথামালা, সবি আজও আমাদের ঘিরে আছে, শুধু এক মানুষ হুমায়ূন আহমেদ আর আমাদের মাঝে নেই । এতে যেমন আমাদের কষ্ট হয়, উনারও কি কষ্ট হয় ? উনি যেমন বলেছিলেন, পৃথিবীতে ফিনিক ফোটা জোছনা আসবে, শ্রাবণ মাসে টিনের চালে বৃষ্টির সেতার বাজবে । সেই সব অপূর্ব অলৌকিক সংগীত শোনার জন্য আমি আর থাকবো না। কোন মানে হয়? সত্যিই কোন মানে হয় না ।

এবার আসি সেই গল্পে, যেভাবে উনার সাথে আমার দেখা হয়েছিল । সাল ২০১২ । তখন আমি সবে এক মাস হলো ঢাকায় এসেছি । ভার্সিটি কোচিং করছি, থাকি বুয়েটের আহসানউল্লাহ হলে, এক বড় ভাইয়ের সাথে । উনিশে জুলাই আমরা খবর পেলাম আমাদের প্রিয় লেখক টি আর নেই । আমাদের মিসির আলী, আমাদের হিমু, আমাদের বাকের ভাই, শুভ্র, আমাদের কবি যেন কেউ ই নেই আর, যেন কোথাও কেউ নেই । তেইশে জুলাই উনার মরদেহ শহীদ মিনারে রাখা হয় স্বর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধাঞ্জলী জানানোর জন্য । আহসানউল্লাহ হল থেকে শহীদ মিনারের দূরুত্ব পায়ে হাঁটা পথে মিনিট পনের কুড়ির পথ । 
সেদিন থেমে থেমে টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছিল । এই রোদ এই বৃষ্টি । শহীদ মিনারে মানুষের ঢল । হলুদ পাঞ্জাবী পড়া কত যুবকই না সেদিন এসছিল! তাদের সাথে কি নীল শাড়ী পড়া রূপা'রাও এসেছিল? মনে নেই । সবাই লাইন ধরে একে একে উনার কফিন পাড় করে যাচ্ছিল । আমি যাই নি । আমি দূর থেকে উনার কফিন দেখে চলে এসেছিলাম । ওভাবে ঐ কফিনের মাঝে উনাকে দেখতে আমার ইচ্ছা হয় নি। তাছড়া হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, ভালবাসার মানুষদের খুব কাছে  কখনো যেতে নেই!

শেষ করছি উনার তিন লাইনের একটা কবিতা দিয়ে । যে তিনটা লাইন আমি বহুদিন মাথায় নিয়ে ঘুরেছি, যার অর্থ খুঁজে বেড়িয়েছি । হয়তো সেই অর্থ খুঁজে পেয়েছিলাম কিংবা পাইনি । সবকিছুর অর্থ খুঁজতে হয় না, তাছাড়া আবেগ অনুভূতির অর্থ খুঁজে পাওয়াও যায় না । সেই বিশাল আবেগ আর গভীর অনুভূতি নিয়েই হয়তো উনি লিখেছিলেন,

                                                   দিতে পারো একশ ফানুশ এনে
                                                         আজন্ম সলজ্জ্ব সাধ,
                                           একদিন আকাশে কিছু ফানুশ উড়াই।


লেখকঃ দীপক কর্মকার

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ